Recents in Beach

নিশা ও রাজ : এক অমর প্রেমের গল্প

 

লাভ স্টোরি

নিশা ও রাজের চিরন্তন প্রেমের গল্প পড়ুন বাংলায় । চা বাগান ও পাহাড়ের পটভূমিতে রচিত এই হৃদয়স্পর্শী প্রেমের কাহিনী আপনাকে আবেশ করে রাখবে । একটি স্যাড লাভ স্টোরি যা ভালোবাসার প্রকৃত  অর্থ বোঝায় ।

কার্শিয়াঙের এক প্রান্তে, নীলাভ পাহাড়ের কোলে ধাপে ধাপে সাজানো চা বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী। পাহাড়ের চূড়ায় জড়ানো কুয়াশা যেন প্রকৃতিরই এক রহস্যময় আবরণ। এই সৌন্দর্যের মাঝেই বেড়ে উঠেছিল নিশা। তার চোখদুটি ছিল পাহাড়ি ঝরনার মতোই এক উচ্ছ্বল প্রাণশক্তিতে ভরপুর, চঞ্চল কিন্তু উজ্জ্বল, স্বচ্ছ ।

প্রথম দেখা : উৎসবের রাতে

সেদিন গ্রামে বার্ষিক মেলা বসেছিল। আলো, গান আর উৎসবের রেশে মুখর ছিল চারপাশ অনুষ্ঠানের মঞ্চে নাচছিল নিশা । তার নাচের মোহনীয়তায়, দর্শকদের ভিড়ে মুগ্ধ হয়ে স্থির দৃষ্টিতে নিশার দিকে তাকিয়ে ছিলো এক যুবক । তার নামই ছিলো রাজ । নিশারই গ্রামের এক যুবক । উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে পড়াশোনা শেষ করে সে ফিরে এসেছিল তার প্রিয় গ্রামে, সবুজের মাঝে । নাচ শেষ হলে রাজ এগিয়ে গেল নিশার কাছে।

"তোমার নাচ... খুব সুন্দর," নিশাকে বললো রাজ একটু লজ্জা নিয়ে।

নিশা হেসে উত্তর দিল, "ধন্যবাদ।"

সেই প্রথম কথার সূত্র ধরে শুরু হল তাদের বন্ধুত্ব।

বন্ধুত্ব যেখানে প্রেমে রূপ নিল

দিন যায়, সপ্তাহ যায় । নিশা আর রাজের প্রায়ই দেখা হতো । আসলে রাজই যেতো যেখানে নিশা টিউশন পড়তে যেতো বা কলেজ থেকে যে পাহাড়ী রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে নিশা বাড়ি ফিরতো । দেখা হলেই দু’জনের টুকটাক কথা হতো । সেই দিয়েই শুরু । তারপরে তারা সেই পাহাড়ী রাস্তা ধরে একসাথে হেটে হেটে গ্রামে ফিরতো ।চা বাগানের মাঝখান দিয়ে সরু পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা গল্প করত। কখনো বসে শুনত পাখির ডাক, কখনো দেখত সূর্যাস্ত। তাদের মনে হল, তারা যেন চিরকালই একে অপরকে চিনত।

তারপরে তারা একে অপরের সাথে দেখা করতো, কথা বলতো, গল্প করতো । রাজ নিশাকে শহরের গল্প করতো, আর নিশা রাজকে শোনাতো তার গ্রামের ঝরনার গল্প, পাহাড়ের গল্প, তার মিষ্টি-মধুর গলায় নেপালী ভাষায় গান শোনাতো । একদিন সন্ধ্যায়, পাহাড়ের কোলে পুরনো একটি কৃষ্ণচূড়ার  নীচে বসে ছিল তারা। পাতার মর্মর শব্দের মাঝে রাজ নিশার হাত ধরল। বলল, "তুমি আমার জীবনকে এত সুন্দর করে তুলেছ, নিশা। তুমি ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। আমায় বিয়ে করবে?"

নিশার চোখ জলে ভরে উঠলো । ধীরে ধীরে সে তার মাথাটা নিয়ে রাজের কাঁধে রাখলো । তার নীরবতাই যেন বলে দিচ্ছিলো সব কিছু, যেন এতোদিন এই প্রস্তাবটার অপেক্ষাতেই সে ছিলো ।

দুটি হৃদয়ের মিলন

তাদের ভালোবাসার কথা শুনে উভয় পরিবারই খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। আয়োজন করা হলো জমকালো একটি বিয়ের। শাঁখের শব্দ, উলুধ্বনি আর শুভেচ্ছায় তাদেররিয়ে তুললো গোটা গ্রাম। নিশা আর রাজ পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বরণ করে নিল মালা বদল করে। আর দু’জনে শপথ নিলো সারাজীবন একসাথে পথ চলার

বিয়ের পর তাদের জীবন ছিল যেন এক সুখের স্বপ্ন। ছোট্ট একটি বাড়ি, সকালবেলা সবাই মিলে একসাথে চা পান, তারপরে চা-বাগানে একসঙ্গে কাজ করতে যাওয়া, আর সারাদিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় একসাথে বসে আড্ডা, গল্প, আগামীর স্বপ্নের জাল বোনাএটাই ছিলো তাদের নিত্যকর্ম । পুরো পরিবার হাসি-খুশিতে মেতে উঠেছিলো । তাদের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই ছিল সবচেয়ে বড় সুখ। ছুটির দিনে তারা যখন একে অপরের হাত ধরে ঘুরতে বেড়াতো, তাদের হাসিমাখা-ঝলমলে মুখ দেখে সবাই বুঝতে পারতো সুখের সংজ্ঞা কি ।

কিন্তু... সুখ বেশিদিন থাকে না

কিন্তু নিয়তির ছিল অন্য পরিকল্পনা। হঠাৎ করেই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন রাজ। প্রথমে সবার ধারণা ছিল সর্দি-জ্বর, কিন্তু দিন যত গড়াল, তার অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগল। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বাড়ির বড়দের জানালো, এই অসুখ থেকে রাজের আর ফেরা হবে না । নিশাকে সেইসব কথা কিছু জানানো হলো না । নিশা দিনরাত রাজের পাশেই থাকতো, তার ওষুধ খাওয়া, খাবার খাওয়া, সেবা-শুশ্রুষা সব সে নিজের হাতে করতো । কিন্তু রাজের অবস্থার উন্নতি হলো না, আরো অবনতি হতে লাগলো । ডাক্তাররা অনেক রকম ভাবে চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না । একদিন ভোরবেলা, রাজের চোখ দুটি নিষ্পলক, নিথর হয়ে গেলো । সেই নিষ্পন্দ দৃষ্টিতে নিশার দিকে তাকিয়ে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে সে যেন বার বার আর্তনাদ করে বলছিলো, "আমি চলে যেতে চাইনি নিশা । আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম, বাঁচতে চেয়েছিলাম । কিন্তু আমি চলে গেলেও আমার ভালোবাসা চিরদিন তোমার সঙ্গে থাকবে, নিশা।"

রাজ ছাড়াই জীবন

রাজের মৃত্যু নিশার সমস্ত পৃথিবীকে যেন অন্ধকার করে দিল।

রাজ চলে গেছে, কিন্তু নিশার জীবন থেমে থাকেনি। সে তাদের বাড়িতেই থাকতে লাগল। তার বাবা-মা বললেও সে তার বাপের বাড়ি ফিরে গেলো না । প্রতিদিন সকালে সে রাজের তৈরী করা ফুলের বাগানে যেতো, গাছগুলিতে জল দিতো, তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতো । তাদের পরশে যেন সে খুজে নিতে চাইতো হারিয়ে যাওয়া রাজের পরশ ।

প্রতি সপ্তাহে অন্তত: দু’বার সে রাজের সমাধিতে যেতো । পাহাড়ের উপর, সে্ই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে, যেখানে তারা দেখা করতো, গল্প করতো । রাজের বাগানের গাছে হওয়া ফুল নিয়ে নিশা ছড়িয়ে দিতো তার সমাধির উপর । সেই সমাধির উপর হাত বুলিয়ে দিতো সে, তারপর সেই সমাধির উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকতো । হয়তো রাজের কাঁধে মাথা রেখে যেমন গল্প করতো, তেমন্ই তারা গল্প করতো, মনের কথা শোনাতো । 

চিরন্তন মিলন

দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল । একদিন সন্ধ্যায়, নিশা রাজের সমাধিতে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো । হঠাৎ তার মনে হলো, চারপাশে一এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, চারদিকে একটা সুন্দর ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিলো নিশা বুঝতে পারছিলো গন্ধটা রাজের প্রিয় জুঁইফুলের । সে যেন রাজের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলো । সে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজ । ছায়া ছায়া চেহারা, কিন্তু ঠিক আগের মতোই, প্রাণভরে হাসছে সে

নিশা অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে বললো “রাজ!”

"হ্যাঁ, নিশা, আমি এসেছি তোমার কাছে, যাবে আমার সঙ্গে ?" রাজ মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো

নিশা চোখে ঘোর নিয়ে, নেশাগ্রস্তর মতো এগিয়ে গেলো সেই বাড়ানো হাতের দিকে । ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে তার চেহারাটা পাহাড়ের কিনারা থেকে পড়ে যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেলো রাজের বাড়ানো সেই হাতের দিকে ।

হয়তো কোথাও গিয়ে সে নাগাল পেয়েছে সেই বাড়ানো হাতের, মিশে গেছে সে রাজের বুকে চিরকালের মতো । হয়তো রাজের কাঁধে মাথা রেখে সে শান্তি পেয়েছে তার অপূর্ণ ভালোবাসার, অপূর্ণ জীবনের । হয়তো সে রাজকে বলতে পেরেছে, রাজ বিনা তার দুর্বিষহ জীবনের অভিজ্ঞতার সেই দিনগুলোর কথা ।    

গ্রামবাসীরা রাজের পাশেই তার সমাধি করে দিয়েছে । যেখানে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । যার নীচে তারা এসে বসতো, গল্প করতো, স্বপ্নের জাল বুনতো । আজ সেখানেই তারা দু’জনে পাশাপাশি পরম শান্তিতে শুয়ে থাকে । আর কৃষ্ণচূড়া গাছটি পরম যত্নে হাওয়া দিয়ে সমাধির উপরে জমা ধুলো উড়িয়ে দেয়, ফুল বিছিয়ে সাজিয়ে দেয় তাদের সমাধির উপর । মাথা উঁচু করে জানান দেয়, এক অমর প্রেমের জয়গানের । 

নিশা ও রাজের গল্প আমাদের শেখায়, সত্যিকারের ভালোবাসা কোনো দিন মরে না। এটি এমনএক শক্তি, যা মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। তাদের গল্প বাংলার পাহাড় ঘেরা, চা-বাগানের প্রকৃতি মতোই চিরসবুজ, ঝরনার স্রোতের মতোই চিরন্তন । এটি শুধু একটি গল্প নয়; এটি একটি বিশ্বাস, যে প্রিয়জন চলে গেলেও, তাদের ভালোবাসা আমাদের সাথে থাকে।

 

এই গল্পটি আপনার কেমন লাগলো? নিচে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। আর এমনই আরো অনেক গল্প পড়ার জন্যে - ক্লিক করুন 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ