একটি গা ছমছমে বাংলা ভূতের গল্প। রহস্যে ঘেরা এক পুরনো বাড়ি, একটি নীল চেলি পরিহিত আত্মা, এবং এক তরুণীর অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মর্মস্পর্শী কাহিনী।
বাংলা ভূতের গল্প : নীল চেলির ভূত
গল্পের শুরু
শহর থেকে অনেক দূরে, একটি নিস্তব্ধ গ্রামের শেষ প্রান্তে পুরানো কুঠুরী বাড়িটা একা-নি:সঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়েছে । পুরনো বাড়িটি দেখলে মনের মধ্যে যেমনটা ভাব আসে, বাড়িটা ঠিক তেমনই ছিলো । দোতলা বাড়িটির দেয়ালের হলুদ রং খসে পড়তে শুরু করেছে । কাঠের কারুকাজ করা বারান্দাগুলোয় জমে আছে ধুলো আর মাকড়সার জাল । দিনের বেলাতেও কেমন যেন আলো-আধারি ভাব । বাড়ির সামনের বাগানটা আগাছায় ভরে গেছে, যেন প্রকৃতি নিজের আধিপত্য ফিরে পেতে চাইছে । স্থানীয় মানুষেরা এই বাড়িটিকে এড়িয়ে চলতো । তাদের মুখে শুধুই সতর্কবাণী, “সন্ধ্যার পর ওই দিকে না যাওয়াই ঠিক হবে বাবু ।”
কিন্তু আমার দাদু, যিনি ছিলেন এক জেদী পুরুষ এবং অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারী পার্সন, অবসরের পরে নিরিবিলিতে থাকবেন এই অভিপ্রায়ে সেসব কথায় কান না দিয়ে অতি শস্তায় সেই বাড়িটি কিনে ফেললেন । তারপরে লোক লাগিয়ে দিলেন, বাড়িটা সাফ-সাফাই করার জন্য । তার বক্তব্য, ভূত-প্রেত নামক কোনো জিনিসের অস্তিত্বই নেই । সবই কুসংস্কার । দিদিমাকে নিয়ে তিনি সেখানেই নাকি থাকবেন । আমি তখন কলেজে পড়ি, আর গ্রীষ্মের ছুটিতে বাধ্য হয়েই তাদের সাহায্য করার জন্য তাদের সাথে থাকতে গেলাম ।
প্রথম রাতটা ছিল স্বাভাবিক । শব্দহীন, নিস্তব্ধ । শুধু জোনাকি ভরা আকাশ আর গভীর অন্ধকার ।
দ্বিতীয় রাত থেকে অদ্ভুত ঘটনাগুলো শুরু হল ।
রাত দুটো-আড়াইটার দিকে । গভীর ঘুম থেকে আমাকে জাগিয়ে দিল এক ঝলকানি আলো । মনে হল, যেন কেউ একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নীচের তলায় হেঁটে বেড়াচ্ছে । আলোটা নড়ছিলো, আস্তে আস্তে, যেন কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে । আমি ভাবলাম, দাদু হয়তো জল খাওয়ার জন্য নীচে নেমেছেন । কিন্তু হারিকেন কেন ? বাড়িতে তো ইলেকট্রিসিটি আছে ।
কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে আমি বিছানা থেকে উঠে পড়লাম । ধীরে ধীরে দরজা খুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম । নিচের তলায় হারিকেনের আলোটা তখনও নড়ছিলো, করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল দূরে, রান্নাঘরের দিকে ।
আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, “দাদু?”
আলোটা সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো আর দপ করে নিভে গেলো । আর তখনই একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা আমার গায়ে লাগলো, যেন বরফের কেউ আমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো । আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো । আমি তড়িঘড়ি করে ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম । নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটা নিশ্চয়ই একটা স্বপ্ন ।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে আমি দাদুকে রাতের ঘটনা বললাম । দাদু হেসে উড়িয়ে দিলেন । “ওসব কিছু হয়নি তোর । হয়তো ঘুমের মধ্যেই দেখেছিস সব,” বললেন তিনি । কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমি জেগেই ছিলাম ।
তৃতীয় রাতে যে ঘটনাটা ঘটলো তাতে আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম ।
আমি পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসেছিলাম । হঠাৎ করেই আমার পেছনে থাকা আলমারির কাঁচের দরজায় যেন একটা ঝাপটা পড়লো । আমি চমকে উঠে ফিরে দেখলাম, কিন্তু কিছুই নেই সেখানে । শুধু আমার নিজের প্রতিবিম্ব । আমি আবার বইয়ে মন দিতেই, এবার শুনলাম যেন কেউ গুনগুন করে গান গাইছে । খুব মৃদু, খুব করুণ। গানের সুরটা ছিল পুরনো দিনের, মনে হয় যেন বহু বছর আগের কোনো পালা গান ।
আমি নিঃশ্বাস রোধ করে কান পেতে রইলাম ।
গানটা আসছিল ঠিক আমার ঘরের বাইরে, করিডোর থেকে । আমি সাহস করে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলাম ।
করিডোরটা ছিল অন্ধকার । কিন্তু তার মাঝখানে, সামনের দিকের বারান্দার কাছে, একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিলো । আর সেই আলোর মাঝে যেন দাঁড়িয়ে ছিল একটি মেয়ে । সে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে । তার পরনে নীল রঙের একটি শাড়ি, কাঁধ পর্যন্ত খোলা চুল । সে নিজমনে গুনগুন করেই যাচ্ছিলো ।
আমার হৃদপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো । আমি চোখ রগড়ে দেখলাম । নাহ, সে সত্যিই সেখানে আছে । কিন্তু তার শরীরটা কেমন যেন একটু স্বচ্ছ, একটু ঝাপসা । অনেকটা যেন আলোর মতই, কিন্তু আঁধার মেশানো ।
আমি নড়তে পারছিলাম না । শুধু তাকিয়ে রয়েছি সেই দিকে ।
হঠাৎ, গান থেমে গেলো । সেই মেয়েটি ধীরে ধীরে পেছন ফিরলো । আমার দিকে তাকালো ।
তার চেহারা আমি কখনও ভুলবো না । খুব সাধারণ, কোমল মুখ। কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল অগাধ বেদনায় ভরা । সে যেন কাউকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারছে না । সে আমাকে দেখে, তার হাতটা একটু উঁচু করল, যেন ইশারা করছে ।
তারপরই, এক সেকেন্ডের মধ্যে, সে উবে গেল । আলোটাও যেন হারিয়ে গেলো । সমস্ত করিডোরটা নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ, অন্ধকার হয়ে গেলো ।
সেই রাতে আমার ঘুম হয়নি । আমি জানতাম, এটা কোনো কল্পনা নয়। আমি স্পষ্ট দেখেছি ।
পরের দিন আমি স্থানীয় কিছু বয়স্ক মানুষের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম । দাদুকে কিছু না বলে, আমি গ্রামের চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকু, ওই যে পাশের বাড়িটা, সেটা সম্পর্কে কিছু জানেন ?”
বৃদ্ধটি আমার দিকে তাকালো, চোখে একটা ভয় । “তুমি কি সেখানে থাকো?” তিনি জানতে চাইলেন ।
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়লাম ।
তিনি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন । “ওই বাড়িটা অনেক বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে । প্রায় চল্লিশ বছর হবে । সেখানে এক পরিবার থাকতো । বাড়ির মেয়েটির নাম ছিল মালতী । খুব সুন্দরী মেয়ে, সে সব সময় নীল রঙের একটা শাড়ি পরতো, লাল পাড় দেওয়া ।”
কথাগুলো শুনে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন ঠাণ্ডা বরফের স্রোত নেমে গেলো ।
বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, “মালতীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল গ্রামেরই এক যুবকের সাথে । কিন্তু বিয়ের ঠিক দু’দিন আগে, এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে । মালতীকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় । আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা, কেউ জানে না । কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে যে, ওই বাড়িতে তার আত্মা রয়ে গেছে । মানুষ তাকে ‘নীল চেলির ভূত’ বলে ডাকে । অনেকেই তাকে দেখেছে, রাতে হাঁটতে, গান গাইতে । কিন্তু সে কাউকে কষ্ট দেয় না । শুধু... শুধু যেন তার কোনো কথা বলার আছে ।”
আমি বুঝতে পারলাম, মালতী আমাকে কিছু বলতে চায় ।
সেদিন রাতে, আমি ভয়কে জয় করার সিদ্ধান্ত নিলাম । আমি একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নিচে নেমে গেলাম । আমি যেখানে তাকে দেখেছিলাম, সেই করিডোরের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম । আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম । জ্যোৎস্না পড়েছে বাগানে ।
“মালতী,” আমি ডাকলাম, যদিও ভয়ে আমার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, “তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাও ? আমি তোমার কথা শুনতে চাই ।”
কিছুক্ষণ কিছুই হল না । শুধু শব্দহীনতা ।
তারপর, হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল । আমি ঘুরে দাঁড়াতেই, সে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে । এবারে আরও স্পষ্ট । তার নীল শাড়ি, করুণ চোখ ।
সে কোন কথা বললো না, কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো । সে তার হাত দিয়ে বারান্দার দিকে ইশারা করল ।
আমি তার ইশারা অনুসরণ করে বারান্দায় গেলাম । সে আমার পেছনে পেছনে এল, তার উপস্থিতিতে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল ।
সে বারান্দার এক কোণায়, একটা মাটির টবের দিকে ইশারা করল । টবটায় একটা বটগাছ গজিয়েছে, সেটাই হয়তো বাড়ির দেয়াল ফাটলের কারণ ।
আমি বুঝতে পারলাম, সে আমাকে ওই জায়গাটা দেখাতে চাইছে ।
পরের দিন সকালে, আমি দাদুকে সব কথা খুলে বললাম । প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে চাননি । কিন্তু আমার জেদের কাছে, আর মালতীর কাহিনী শুনে, তিনি শেষমেশ রাজি হলেন । আমরা বেলচা-কোদাল নিয়ে ওই মাটির টবটা সরালাম এবং তার নীচে খোড়া শুরু করলাম ।
কিছুক্ষণ খোঁড়ার পর, বেলচার ডগায় শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা লাগল । আমরা হাত দিয়ে মাটি সরিয়ে দেখলাম, একটা পুরনো, পিতলের টিনের বাক্স ।
বাক্সটা বের করে খুললাম । তার ভেতর ছিল কিছু পুরনো চিঠি, একটা ডায়েরি, আর একটা হলুদ হয়ে যাওয়া ছবি । ছবিতে একটা সুন্দরী মেয়ে, ঠিক যেমনটা বৃদ্ধ বর্ণনা করেছিলেন, নীল শাড়ি পরা । সে হাসছে, তার পাশে এক যুবক ।
ডায়েরিটি ছিল মালতীর । আমরা পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগলাম ।
ডায়েরির শেষের দিকে, বিয়ের দু’দিন আগের লেখা কথাগুলোয় আমাদের চোখ আটকে গেল ।
“আজ আমার খুব খারাপ লাগছে । শ্যামল (তার বাগদত্তা) আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে । সে লিখেছে, আমাদের বিয়ে হতে পারে না । সে শহরে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছে । আমি আমার পরিবারকে সেই সত্যিটা জানাতেও পারছি না । তারা আমার বিয়ের তোড়জোড়ে মশগুল । আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলো । আমি এটা মানতে পারছি না । আজ রাতে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম, জ্যোৎস্না দেখছিলাম । হঠাৎ আমার মাথা ঘুরে উঠলো, আমি বারান্দার রেলিং থেকে নীচে পড়ে গেলাম । আমার পিঠে আর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, কেউ আমাকে দেখতে পায়নি । আমি বুঝতে পারছি যে আমি মারা যাবো, কিন্তু আমি কাউকে কিছু জানাইনি । কারণ, আমি এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি চাইছি । শুধু আফসোস হচ্ছে ... শ্যামল, তুই কেন এমন করলি ? আমার একটা শেষ ইচ্ছা, যেন আমার পরিবারের সকলে জানতে পারে যে, আমি আত্মহত্যা করিনি । সবাই আমার মৃত্যূকে আত্মহত্যা ভেবে আমার পরিবারকে ভুল বুঝবে এটা আমি চাই না । এটা শুধু একটা দুর্ঘটনা, যা আমি চেপে গিয়েছি । আর সেই শেষ চিঠিটা, যে চিঠি শ্যামল আমাকে লিখেছে, সেটা আমি মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছি...”
আমরা চিঠিগুলোর মধ্যে খুঁজে পেলাম শ্যামলের লেখা সেই বিদায়ের চিঠি । সে মালতীকে ত্যাগ করেছিল সম্পদ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য, এক ধনী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করার লোভে ।
সব সত্যি প্রকাশ পেল । মালতীর পরিবার বহু বছর ধরে ভেবেছিলো, সে আত্মহত্যা করেছে, তাই তারা লজ্জায় চুপ ছিল । কিন্তু আসলে সে মারা গিয়েছিল এক দুর্ঘটনায়, আর তার প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণায় ।
আমরা স্থানীয় পুলিশ ও গ্রামের প্রধানদের ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম । শ্যামল তখনও বেঁচে ছিল, কিন্তু এখন সে এক বুড়ো মানুষ । সত্যি প্রকাশ পেতেই তার পরিবার ও সমাজের অপমান সইতে হয়েছিল তাকে । মালতীর পরিবারের কাছে সে ক্ষমাও চাইলো ।
এরপর, আমরা মালতীর জন্য একটি শান্তির আয়োজন করলাম । একজন পুরোহিত ডেকে তার আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হলো । তারপরে আমরা তার ছবি ও জিনিসপত্র গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলাম ।
সেই রাত থেকে, বাড়িতে সব অদ্ভুত আওয়াজ, আলো, আর উপস্থিতি বন্ধ হয়ে গেল । নীল চেলির ভূত আর কখনও দেখা যায়নি ।
মালতী শান্তি পেয়েছিল । সে শুধু চাইতো, তার মৃত্যুর সত্যিটা সবাই জানুক। তার অপমৃত্যুর গ্লানি থেকে সে মুক্তি পাক ।
আমরা শেষ পর্যন্ত বাড়িটাকে সংস্কার করালাম । এখন সেখানে আবার জীবন ফিরে এসেছে । কিন্তু আমি কখনও ভুলি না সেই গ্রীষ্মের রাতগুলো, যখন আমি এক বেদনাময়ী আত্মার সাথে কথা বলেছিলাম, যে শুধু একটু ন্যায় আর শান্তি চেয়েছিল । তার সেই করুণ চোখ দুটো, আর নীল শাড়ির ঝলক আমি আজও ভুলতে পারিনি । এটি কোনো ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প নয়, এটি একটি মর্মস্পর্শী আত্মার কাহিনী, যে প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলো ।
.jpg)
0 মন্তব্যসমূহ