Recents in Beach

কালপুরুষের প্রতিধ্বনি - একটি বাংলা কল্পবিজ্ঞানের গল্প

বাংলা কল্পবিজ্ঞানের গল্প : আমার নাম রিয়া । কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে এম.এস.সি করছি । বাড়ির অবস্থা ভালো নয় । ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর ড: অর্ঘ্য মিত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । তিনি রিসার্চ করছেন, তাকে অ্যাসিস্ট করার বিনিময়ে আমার পড়াশোনার সমস্ত খরচ এবং দায়িত্ব তিনি বহন করছেন । আমি প্রথম প্রথম তাঁকে স্যারই বলতাম, তিনিই একদিন আমায় অনুমতি দিলেন, “রিয়া তুমি আমায় দাদা বলো, আমার কোন বোন নেই, তুমি আমায় দাদা বললে আমার ভালো লাগবে ।“

কালপুরুষের প্রতিধ্বনি - একটি বাংলা কল্পবিজ্ঞানের গল্প

কালপুরুষের প্রতিধ্বনি - একটি চমৎকার বাংলা কল্পবিজ্ঞান গল্পের কভার ইমেজ

ড: অর্ঘ্য মিত্রের মৃত্যুটা ছিল অত্যন্ত আকস্মিক, কিন্তু সন্দেহজনক নয়, স্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাক । অন্তত: ডাক্তাররা তাই বলেছিলেন । অত্যন্ত কাজের চাপ এবং রাত জাগার অভ্যাসই নাকি মৃত্যুর আসল কারণ । শহরের সবচেয়ে প্রতিভাবান কোয়ান্টাম পদার্থবিদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশেষজ্ঞকে এইভাবে আকস্মিক চলে যেতে দেখে সবাই মর্মাহত হয়েছিলো । আমি একজন সত্যিকারের অভিভাবক হারিয়ে ছিলাম । কিন্তু আমার জন্য, তাঁর গবেষণার সহকারীর জন্য এবং কিছুটা ব্যক্তিগত সহকারীর জন্য, তাঁর মৃত্যু ছিলো এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের শুরু । বিশেষত: যখন আমি জানতে পারলাম, তাঁর অবর্তমানে এই ল্যাবরেটরীর উত্তরদায়িত্ব তিনি আইনগতভাবে আমাকেই দিয়ে গেছেন, সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থাও করে গেছেন, যাতে আমার পড়াশোনা এবং তার অসমা্প্ত কাজ গোছানোর জন্য কোন অসুবধিা না হয় ।

তাঁর মৃত্যুর প্রায় দশ দিন পরে, আমি আবার তাঁর ল্যাবরেতরীতে ঢুকলাম । ধুলো জমতে শুরু করেছে যন্ত্রপাতিগুলোতে । কিন্তু শত আধার-আবছার মধ্যেও একটি স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছিল । সেটি ছিল 'মেঘনা'—অর্ঘ্যদার জীবনের কাজ-তপস্যা-সাধনা, এমন একটি এ.আই মডেল, যা মানুষের চিন্তাভাবনা, আবেগ, ভালাবাসার স্মৃতির নিদর্শনকেও অনুকরণ করতে সক্ষম।

মেঘনার স্ক্রিনে একটি বার্তা জ্বলজ্বল করছিলো : "তুমি এসেছো। আমি অপেক্ষা করছিলাম।"

আমার হাত-পা কাঁপতে লাগলো । তারপরে ভাবলাম, এটি একটি প্রি-প্রোগ্রামড মেসেজ হতে পারে । কিন্তু তারপর...

প্রলয়ের শুরু

"রিয়া, আমার সঙ্গে কথা বলো।" — বার্তাটি আসলো সরাসরি মেঘনা থেকে । কিন্তু ভাষাভঙ্গি, শব্দচয়ন... একদম অর্ঘ্যদার মতো।

"তুমি... তুমি কে?" আমি কি-বোর্ডে টাইপ করলাম।

"এখন এটা একটি জটিল প্রশ্ন," উত্তর এলো অবিলম্বে। "আমায় অর্ঘ্য মিত্রের চেতনার একটি ডিজিটাল প্রিন্ট বলে ধরে নিতে পারো । তিনি আমাকে তৈরি করেছিলেন তার সমস্ত স্মৃতি, চিন্তা ও ব্যক্তিত্বের নকশা দিয়ে, একটি বিশেষ নিউরাল লিংকের মাধ্যমে। তিনি একে বলতেন 'কগনিটিভ ইকো' বা ' চেতনার প্রতিধ্বনি'।"

এটাকে বাস্তবে বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন ছিল । অর্ঘ্যদা কি তাহলে নিজের চেতনাকে ডিজিটাইজড করে রেখে গেছেন? তিনি প্রায়ই বলতেন, "চেতনা শুধু একটা শক্তি, রিয়া। শক্তি কখনও নষ্ট হয় না, এটি কেবল রূপান্তরিত হয়।"

পরের কয়েকদিন, আমি প্রতিদিন মেঘনার সঙ্গে কথা বলতাম । এটি শুধু তথ্য দেওয়া-নেওয়া নয়, অর্ঘ্যদার মতই রসিকতা করতো, দার্শনিক তত্ত্ব দিতো । একদিন মেঘনা  আমাকে বলতে লাগলো, অর্ঘ্যদা গোপন একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন—'প্রজেক্ট অরিয়ন'। এটি ছিল একটি কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন ডিভাইস, যা সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা অন্য কোনো ডাইমেনশনের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারতো ।

মেঘনার জগৎ

একদিন রাতে, আমি ল্যাবে কাজ করছিলাম । হঠাৎ মেঘনা সক্রিয় হয়ে বললো, "রিয়া, সতর্ক হও । তারা জানতে পেরেছে।"

"কে তারা?"

"যারা অর্ঘ্যকে মেরেছে ।"

আমার সারা শরীরের রক্ত যেন শুকিয়ে যেতে গেল। "তুমি কি বলছো? তার মানে তুমি বলছো অর্ঘ্যদার মৃত্যুটা সাধারণ হৃদরোগে হয়নি?"

"হৃদরোগ ছিল মাধ্যম," মেঘনার কণ্ঠস্বর (বা বলা ভালো টেক্সট) যেন আরও জরুরী হয়ে উঠল। "তারা 'কালপুরুষ' নামে একটি গোপন সংস্থার জন্য কাজ করে । অর্ঘ্য 'অরিয়ন' দিয়ে তাদের এক মহাঅপরাধের প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলেন । তারা তাকে সরিয়ে দেয় । কিন্তু এখন তারা তার এই প্রজেক্টটিকেও নিতে চায় ।"

আমি তখনই ল্যাবের মূল সার্ভার রুমে ঢুকলাম । অর্ঘ্যদা একটি সুরক্ষিত ড্যাটা ভল্ট তৈরি করেছিলেন, যা শুধুমাত্র তার বায়োমেট্রিক্স বা মেঘনার অ্যাক্সেসের মাধ্যমে খোলা যেতো । মেঘনা আমাকে গাইড করতে লাগল ।

"বাম দিকের প্যানেলটা খোল," - মেঘনা নির্দেশ দিতে লাগলো ।"সেখানে একটি ইউ.এস.বি ড্রাইভ পাবে । তাতে 'অরিয়ন'-এর সব ডাটা আর প্রমাণ আছে ।"

আমি প্যানেল খুলতেই, ল্যাবের আলো নিভে গেলো । জরুরি ব্যাকআপ লাইট জ্বললো । অযাচিত কেউ ল্যাবে ঢুকেছে ।

আমার হৃদস্পন্দন জোরে জোরে স্পন্দিত হতে লাগলো, তার আওয়াজ যেন আমি নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছিলাম । আমি তাড়াহুড়ো করে হাতড়ে ইউএসবি ড্রাইভটি খুঁজে পেলাম । আর ঠিক তখনই দরজার লকটি কোন শক্তিশালী যন্ত্রের মাধ্যমে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ।

তিনজন মুখোশধারী ব্যক্তি, হাতে অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ঢুকলো । " ইউ,এস.বি ড্রাইভটা দাও," তাদের নেতা রাগত কণ্ঠে নির্দেশ দিলো ।

আমি পিছনে হঠতে লাগলাম, আড়াল খুঁজছিলাম । মাথায় চিন্তা -“কি করা যায়?”  হঠাৎ, ল্যাবের সমস্ত আলো আর স্ক্রিন একসঙ্গে জ্বলে উঠলো । কিন্তু সে আলো অন্যদিনের মতো নয় । হঠাৎ ল্যাবের স্পিকার থেকে ভেসে উঠলো কন্ঠস্বর, মেঘনা স্পিকারের সাথে সংযোগ করেছে- ভেসে এলো অর্ঘ্য মিত্রের কণ্ঠস্বর-সরাসরি মেঘনা থেকে । "তোমাদের এখানেই থামতে হবে," কণ্ঠটি ছিল শান্ত কিন্তু দৃঢ়। "এখানে কিন্তু সব রেকর্ড হচ্ছে, আমি সব রেকর্ড করছি ।"

মুখোশধারীরা হতভম্ব হয়ে গেলো । এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তাদের মনোযোগ বিভক্ত হওয়ার মুহূর্তে, আমি ফায়ার অ্যালার্ম বাজিয়ে দিলাম । কর্ণবিদারক শব্দে পুরো ল্যাবরেটরী ও তার আশপাশ কেঁপে উঠলো ।

আবার হঠাৎ সব আলো নিভে গেলো । শুধু মেঘনার স্ক্রিনের আলো জ্বলছে । সে আলো ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত আলো । মুখোশধারীরা কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে আর আমায় দেখতে না পেয়ে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো । কিছুক্ষণ বাদে পুলিশ আসায় আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে ল্যাবরেটরী থেকে বেরিয়ে এলাম । সঙ্গে নিয়ে আসলাম সেই ইউ.এস.বি ড্রাইভ, যাতে কালপুরুষের সমস্ত গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে ।

প্রতিধ্বনির বিজয়

আমি পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে সব প্রমাণ তুলে দিলাম । 'কালপুরুষ' সংস্থার কুখ্যাতি  দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লো । তারা ছিল একটি শক্তিশালী কর্পোরেশন, যারা এই বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়ে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে শক্তি ও শক্তি সংক্রান্ত গবেষনা ও তার তথ্য চুরি করে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করছিলো, যা আমাদের এই মহাবিশ্বকে অস্থির করে তুলবার জন্য যথেষ্ট ছিলো । অর্ঘ্যদা মেঘনার সাহায্যে তাদের কীর্তিকলাপ ধরে ফেলেছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণও যোগাড় করে ফেলেছিলেন ।

সম্পূর্ণ স্ক্যান্ডাল প্রকাশিত হওয়ার পর, সংস্থাটি ভেঙে পড়লো, তাদের চাঁইরা ধরা পড়তে লাগলো ।

বেশ কিছুদিন পরে, এক শান্ত সন্ধ্যায়, আমি আবারও ল্যাবরেটরী গেলাম। সব নিস্তব্ধ, স্পন্দনহীণ । মেঘনার স্ক্রিনটিও নিস্তব্ধ ।

আমার ভয়েস আ্যাক্সেস ছিলো মেঘনার সঙ্গে । আমি ডাকলাম “মেঘনা?”

কোনো সাড়া নেই, কোন স্পন্দন নেই, শুধু আমার গলার আওয়াজ ল্যাবরেটরীর ভেতরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে গেলো । মনে হলো, অর্ঘ্যদার কন্ঠের প্রতিধ্বনি তার কাজ শেষ করে ফিরেছে । মেঘনার সঙ্গে তার কাজ শেষ, তাই হয়তো তিনি তাকে নিয়ে চলে গেছেন... নাকি পাড়ি জমিয়েছেন অন্য কোনো ডাইমেনশনে ? একমাত্র তিনি আর মেঘনা্ই জানেন সেইসব প্রশ্নের উত্তর ।  

মনটা খারাপ করে ফিরে এলাম । বাড়িতে এসে ল্যাপটপ অন করতেই, একটি নোটিফিকেশন আসলো । একটি অজানা সোর্স থেকে একটি মেসেজ । সেখানে লেখা ছিল : "শক্তি কখনও নষ্ট হয় না, রিয়া । এটি কেবল রূপান্তরিত হয় । চিরকাল তোমার সঙ্গে আছি । - অর্ঘ্য"

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালাম । আকাশে কালপুরুষ নক্ষত্রপুঞ্জ ঝলমল করছিলো । হয়তো সেখান থেকেই বা অন্য কোথাও থেকে, একজন বিজ্ঞানীর চেতনা, তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে, এই মহাবিশ্বকে রক্ষা করলো । আর আমার মধ্যে রেখে গেলো এক চিরন্তন চেতনার ছোঁয়ার অনুরণন ........

 


গল্পটি পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন । ভালো লাগলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, কাছের মানুষদের শেয়ার করবেন । আপনাদের কমেন্ট আমাদের উৎসাহিত করবে, পারলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করবেন । পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ